বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে বিপর্যস্ত দেশের অর্থনীতি। কমেছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানি-রপ্তানি। অর্থনীতির এই নেচিবাচক প্রভাবে অর্থবছর শেষে বড় ধরনের ঘাটতি থাকবে রাজস্ব আহরণে। সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে করোনা মোকাবিলায় ১ লাখ ৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ব্যয়। সরকারের আয় কমে গেলেও ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় অর্থ সংকট দেখা দিয়েছে।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার একের পর এক কাঁচি চালাচ্ছে অপ্রয়োজনীয় ব্যয়ে। সর্বশেষ গতকাল রবিবার সরকারি-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভ্রমণ ব্যয় অর্ধেক কমিয়ে অফিস আদেশ জারি করা হয়েছে। পাশাপাশি রুটিন ভ্রমণও বাতিল করা হয়েছে। আদেশে শুধু জরুরি ও অপরিহার্য হলেই ভ্রমণের সুযোগ রাখা হয়েছে।
গতকাল রবিবার অর্থ বিভাগের উপসচিব মো. তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত ওই অফিস আদেশ মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। খবর অর্থ বিভাগ সূত্রের।
আদেশে বলা হয়েছে- করোনা মোকাবিলায় সরকারের অগ্রাধিকার খাতসমূহের প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের মাধ্যমে সীমিত সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে ২০২০-২১ অর্থবছরে সব সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটে ভ্রমণ ব্যয় অর্ধেক কমানো হয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনা সংক্রমণ ও অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলায় বিভিন্ন ব্যয় সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার বাজেট বক্তৃতায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রতি ব্যয় কমানোসহ যেসব নির্দেশনা দিয়েছেন তার মধ্যে রয়েছে, সরকারি চাকরিজীবীদের বিদেশ ভ্রমণে প্রশিক্ষণসহ যে কোনো প্রোগ্রামে অংশ নিতে বিদেশে যেতে পারবেন না।
অন্যদিকে এর আগে সরকারি ব্যয় কমাতে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে অর্থ ছাড়করণ বন্ধ করে অর্থ বিভাগ। পাশাপাশি আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত সব প্রকল্পে গাড়ি কেনাও বন্ধ করেছে সরকার। নভেল করোনা ভাইরাস মহামারী সরকারের ব্যয়নীতিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে। কোনোকালেই ‘ব্যয় সংকোচন নীতির’ তোয়াক্কা না করে চলা সরকার এবার সংকোচন নীতির পথে হাঁটছে। প্রাথমিকভাবে ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘অপ্রয়োজনীয় ব্যয় সংকোচন নীতি’ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এর অংশ হিসেবে আপাতত স্থগিত করা প্রায় ৫০০ কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প থেকে সরকার ৫২ হাজার কোটি টাকা খরচ করবে অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্পে। অর্থনীতি ঘুরে না দাঁড়ালে, রাজস্ব আদায় না বাড়লে অন্যান্য খাত থেকেও টাকা অগ্রাধিকারভিত্তিক উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানান্তর করা হবে। পাশাপাশি মধ্যমেয়াদি বাজেটে আসবে বড় ধরনের সংশোধন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব আহরণের গতিপ্রকৃতি দেখে আপাতত ব্যয় কিছুটা কমিয়ে আনা হচ্ছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত এ নীতি চলবে। এর পরও পরিস্থিতি বদল না হলে অন্য ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, করোনা ভাইরাসের কারণে পুরো অর্থনীতি বিপর্যস্ত। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সরকারের আয়ে। গত অর্থবছর সরকারের রাজস্ব আয়ে ঘাটতি হয়েছে ৮৫ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর সবে শুরু হলেও রাজস্ব আয়ে গতি নেই। তাই পদ্মা সেতু, মেট্রোরেলের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজে যাতে কোনো সমস্যা না হয়, সে জন্য সরকার দুটি নীতি নিয়ে এগোচ্ছে। প্রথম নীতি হলো অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসবহুল খাতে ব্যয় কমানো। দ্বিতীয় নীতি হচ্ছে সাশ্রয়কৃত অর্থ জনগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে স্থানান্তর করা।
প্রথম নীতি অনুযায়ী, উন্নয়ন প্রকল্পগুলোকে তিন ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বা অগ্রাধিকার প্রকল্প, মধ্যম অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প এবং কম অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প। চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আকার দুই লাখ পাঁচ হাজার ১৪৫ কোটি টাকা। এডিপিতে মোট দেড় হাজার প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প, যার সংখ্যা ৫৬২। ৩০ শতাংশ মধ্যম অগ্রাধিকারভিত্তিক প্রকল্প, এর সংখ্যা ৪৬৯। বাকি ৩০ শতাংশ বা ৪৬৯টি প্রকল্প কম গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত। এই কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের অর্থ ছাড় স্থগিত করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি সরকারি যানবাহন কেনা বন্ধ, অপ্রয়োজনীয় বিদেশ ভ্রমণ, আপ্যায়ন ভাতাসহ বিভিন্ন খাতে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানো হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় হিসাব করে দেখেছে, এতে সরকারের সাশ্রয় হবে প্রায় ৫২ হাজার কোটি টাকা।
মন্ত্রণালয় বলছে, সরকারের রাজস্ব আয় কম। তাই জনগুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থায়নে সমস্যা হতে পারে। সর্বাধিক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ যাতে কোনোভাবেই থেমে না যায় বা সমস্যায় না পড়ে, সে জন্য সাশ্রয়কৃত অর্থ এসব প্রকল্পে বিনিয়োগ করা হবে। ফলে পদ্মা সেতুর মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করা হবে সাশ্রয়কৃত ৫২ হাজার কোটি টাকা। রাজস্ব আয়ে গতি যদি না আসে, তবে ডিসেম্বরের পর আবারও বড় ধরনের ব্যয় কাটছাঁটে যেতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক এবং উন্নয়ন অন্বেষণের চেয়ারপারসন ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর আমাদের সময়কে বলেন, আমরা বহু আগে থেকেই ব্যয় কমানোর কথা বলে আসছি। বিভিন্ন প্রকারের অপ্রয়োজনীয় ব্যয় রয়েছে সরকারের। অপ্রয়োজনীয় সরকারি কর্মকর্তাদের খরচ রয়েছে। আবার অনেক উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে যেগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই করা। এ ছাড়া কোন কোন প্রকল্পে সময়ক্ষেপণের মাধ্যমে ব্যয় বাড়ানো হয়। অন্যদিকে প্রকল্পে কেনাকাটা বাবদ বিশেষ মানদ-ের চেয়ে বেশি খরচ করা হয়। এসব ক্ষেত্রে খরচ কমিয়ে তা জনগণের মাঝে বিতরণ করা গেলে অর্থনীতিতে গতি ফিরবে।
Leave a Reply